মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সাঃ)

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সাঃ)

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সাঃ)

মানবতা হল মহান আল্লাহতালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার সুন্দরতম রূপে এবং তাকে দিয়েছেন অসংখ্য অধিকার। আমরা সমগ্র মানবজাতি একই পিতা-মাতার সন্তান। সর্বপ্রথম  মানব  এবং মানবী হযরত আদম (আঃ) ও হযরত হাওয়া (আঃ) এর সন্তান।

মানবাধিকার

মানবাধিকার হলো মানব পরিবারের সকল সদস্যের জন্য সার্বজনীন, সহজাত,  অ-হস্তান্তরযোগ্য এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকার। মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষ মাত্রই এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে। তবে এই চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তির বিনষ্টের কারণ হতে পারবে না। মানবাধিকারের বিভিন্ন দিক রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ-

  •  1. জীবনের অধিকার
  •  2. স্বাধীনতার অধিকার
  • 3.  সম্পত্তির অধিকার
  • 4.  শিক্ষার অধিকার
  • 5.  ধর্মের অধিকার
  •  6. বিচারের অধিকার

 মানবাধিকারের গুরুত্ব অপরিসীম। মানবাধিকারের মাধ্যমে শুধুমাত্র একটি সুন্দর ও শান্তিময় সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সকল মানুষের মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী (সাঃ)

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব এবং সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)।  তিনি মানবতার মুক্তির বার্তা নিয়েই এ জগতে  এসেছিলেন। তিনি ছিলেন মানবতার মুক্তিদাতা। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)  এর আগমনের মধ্যে দিয়েই মানবতার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। তিনি মানবতার জন্য একটি আদর্শ জীবনধারা প্রদর্শন করে গেছেন। তার জীবন এবং তার আদর্শের মাধ্যমে তিনি মানবাধিকারের সকল দিক প্রতিষ্ঠান করতে সক্ষম হয়েছেন।

মানব অধিকারের বিভিন্ন দিক প্রতিষ্ঠায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)  এর অবদান উল্লেখযোগ্য। এই সংক্রান্ত নিম্নে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলোঃ-

জীবনের অধিকার

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)  বলেছেন, ”মানুষের জীবনের নিরাপত্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পবিত্র অধিকার।” হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)  আরো বলেন সবচেয়ে জঘন্যতম অপরাধ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার করা এবং মানুষকে হত্যা করা। পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, ”আল্লাহ যে প্রাণ অহত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করা যাবে না।” (সূরা বনী ইসরাইলঃ- ৩৩)

আল্লাহতালা  কুরআন মাজীদে বলেন,  ”হেতু ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকে হত্যা করল, আর যদি কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করে তাহলে সে যেন সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।” (সূরা মায়েদাঃ- ৩২)

স্বাধীনতার অধিকার

মানুষ  মনোজগতে সব সময় স্বাধীন। যে কারণে তারা বস্তু জগতে ও স্বাধীন থাকতে চাই বা থাকতে পছন্দ করে। মানুষ আল্লাহ ছাড়া কারো গোলামী এবং দাসত্ব করবে না। একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় আল্লাহর গোলামী এবং তার কাছেই শুধুমাত্র মাথা নত করবেন। তাছাড়া কারো  প্রভুত্ব  স্বীকার এবং অন্যায়ের কাছে কখনোই মাথানত করবেন না। ইসলামের পরিভাষায় এটাকেই স্বাধীনতা বলে থাকে।

ইসলামের প্রথম বাক্য কালেমা। আর এ কালেমার মধ্যেই আল্লাহতালা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। কালেমাটি হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ । এর অর্থ, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই হযরত মুহাম্মদ সাঃ আল্লাহর রাসূল। এ ঘোষণার পরে সকল মানব সব ধরনের প্রভুর গোলামী থেকে মুক্তি লাভ করে।

ভালো-মন্দ, সত্য মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় সকল বিষয় বোঝার জন্য আল্লাহতালা মানুষকে জ্ঞান দান করেছেন। তিনি মানুষকে দিয়েছেন চিন্তা ও কাজের স্বাধীনতা আর তার সাথে কর্ম অনুযায়ী পরকালে মানুষের শাস্তি সম্পর্কে ও উল্লেখ করেছেন।

মহানবী সাঃ বলেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তি তার জীবন, সম্পত্তি ও সম্মানের ব্যাপারে স্বাধীন। তিনি দাস প্রথা বিলোপ করে সকল মানুষের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি সকল মানুষের মধ্যে শ্রেণীভেদ, বর্ণভেদ, জাতিভেদ ও ধর্মভেদ দূর করে সকলকে সম অধিকারের অধিকারী করেছিলেন।

সম্পদের অধিকার

মানুষের পার্থক জীবনের প্রয়োজনে সম্পদ অপরিহার্য একটি উপাদান। ইসলামের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তিরই সম্পদের অধিকার রয়েছে তা পুরুষ হোক অথবা নারী। ইসলামের সম্পদের  অধিকারের ক্ষেত্রে কোন রকম বৈষম্য করা হয় না।

ইসলামে সম্পদের অধিকারের মূলনীতি হল প্রত্যেক ব্যক্তির ঐ তার উপার্জিত সম্পদের উপর পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এছাড়া মৃত ব্যক্তিদের সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারের মধ্যে বন্টন বা ভাগ করা হয়। বৈধভাবে সম্পদ অর্জনের জন্য ইসলামের অনুমতি রয়েছে। তবে সম্পদকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পরিণত করতে বারণ করা হয়েছে।

পবিত্র কোরআনে উল্লেখ রয়েছে, ধনেশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি প্রার্থীর জীবনের শোভা এবং স্থায়ী সৎকর্ম তোমার প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য চেষ্টা ও কাঙ্খিত হিসেবে উৎকৃষ্ট। (সূরা কাহাফ আয়াত ৪৬)

উল্লেখিত আয়াত থেকে আমরা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যে সম্পদ জীবনের জন্য প্রয়োজন এবং তা থাকা উত্তম। কিন্তু সম্পর্কে জীবনের চূড়ান্ত উদ্দেশ্যে পরিণত করা সঠিক নয়। মুমিনদের জীবনে চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হলো পরকাল।

ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদ আল্লাহর অনুগ্রহ। সম্পদের সঠিক ব্যবহার মানুষের জন্য কল্যাণকর। বৈধ উপায়ে  সম্পদ অর্জনে ইসলামে কোন বাঁধার সৃষ্টি নেই। নবী- রাসুল থেকে সাহাবায়ে একরাম ও পূর্ববর্তী বহু মনীষী বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক ছিলেন। তবে এদের পার্থক্য হল, তাদেরকে সম্পদ আল্লাহর পথ থেকে বিপথে নিয়ে যেতে পারেনি।

আল্লাহ তাআলা বলেন, সৃষ্টিতে ও গুণাবলীতে তোমাদের একের উপর অন্যের যে প্রাধান্য দিয়েছেন তা দ্বারা  শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করো না। প্রত্যেক পুরুষ তাই পাবে যা  সে অর্জন করেছে এবং প্রত্যেক নারী ও সেগুলোই পাবে যা সে অর্জন করে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে তার অনুগ্রহ প্রার্থনা করো তিনি নিশ্চয়ই সব বিষয়ে অবগত রয়েছেন। (সূরা নিসা, আয়াত ৩২)

ইসলামের দৃষ্টিকোণে কেউ কারো সম্পদ অন্যায় ভাবে আত্মসাৎ করতে পারবে না। অর্থাৎ ইসলামের দৃষ্টি করে জোরপূর্বক কোনো কিছু করার অনুমতি নেই। যদি কেউ অন্যায় ভাবে কারো সম্পদ আত্মসাৎ করে তাহলে সে ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষ নির্বিশেষে সব অপরাধীর সমান শাস্তির বিধান রয়েছে।

শিক্ষার অধিকার

শিক্ষার বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিকোণ খুবই সুন্দর।  শিক্ষা ইসলামের প্রাথমিক মৌলিক বিষয় গুলোর অন্তর্ভুক্ত। আমাদের আদি শিক্ষক হলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। তাই ফেরেশতারা বলেছিলেন, ’হে আল্লাহ, আপনি পবিত্র ! আপনি যা শিখিয়েছেন, তাছাড়া আমরা আর কোন কিছুই জানিনা ;  নিশ্চয় আপনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলে (সুরা বাকারা, আয়াত ৩২)

শিক্ষা এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য পাঠদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কাছে যখন সর্বপ্রথম ওহী  নাযিল হয় তখন ওহীর প্রথম নির্দেশ ছিল, ’পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।  পড়ো তোমার রব মহাসম্মানিত, যিনি শিক্ষাদান করেছেন লেখনীর মাধ্যমে শিখিয়েছেন মানুষকে যা তারা কখনোই জানতো না। (সূরা আলাক, আয়াত ১ থেকে ৫)

ইসলামী শিক্ষায় অধ্যায়ন ও অধ্যাপনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য গ্রন্থ হল আল কোরআন।  মহান আল্লাহ কোরআন শেখাবেন বলে মানব সৃষ্টি করলেন এবং তাকে বর্ণনা শেখালেন। (সূরা রহমান, আয়াত ১ থেকে ৪)

ইসলামী আইন অনুসারে, প্রত্যেক ব্যক্তিরই শিক্ষার অধিকার রয়েছে, তা পুরুষ হোক অথবা নারী। ইসলামে শিক্ষার অধিকারের ক্ষেত্রে কোন রকম বৈষম্য করা হয় না। ইসলামে জ্ঞানকে আল্লাহর দান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই সকলেরই উচিত আল্লাহর দানকৃতজ্ঞ জ্ঞান অর্জন করা। ইসলামে শিক্ষা অর্জন করা হলো ওয়াজিব। আর এটা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অবশ্যই পালনীয়। ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো সকল নাগরিক যেন শিক্ষার সুযোগ সুবিধা ভোগ করতে পারে। শিক্ষার ক্ষেত্রে কোন রকম বৈষম্য হবে না। নারী পুরুষ উভয়ই শিক্ষা সঠিকভাবে অর্জন করতে পারবে।

ইসলামে নারী এবং পুরুষ সকলের জন্য শিক্ষাকে  বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাই ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের অবশ্যই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ”ইলম বা শিক্ষা গ্রহণ করা সকল নর নারীর উপর ফরজ।“ (সুনানে ইবনে মাজাহ)

ইসলামে শুধুমাত্র শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক কি করা হয়নি তার পাশাপাশি জ্ঞানের সুরক্ষার জন্য সব ধরনের মাদকদ্রব্য হারাম বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, হে বিশ্বাসে মুমিনগণ তোমরা মদ, জুয়া, মূর্তি পূজা, ভাগ্য নির্ণায়ক  সবকিছু শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা এগুলো বর্জন করো যাতে তোমরা  সফলকামি হতে পারো। উক্ত আলোচনাগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারছি শিক্ষাকে ইসলামের দৃষ্টি করে কতটা গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়েছে।

ধর্মের অধিকার

ইসলামে ধর্মের অধিকার কি একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ইসলামি আইন অনুসারে, প্রত্যেক  ব্যক্তিরই ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে তা মুসলিম হোক কিংবা অমুসলিম।

ইসলামের ধর্ম পালনের ব্যাপারে বা ক্ষেত্রে কোন রকম বৈষম্য করা হয় না। ইসলামের ধর্মের অধিকারের মূলনীতি হলো, প্রত্যেক ব্যক্তিই তার নিজস্ব ধর্মের বিশ্বাসের অধিকার রয়েছে। ইসলামে ধর্ম বিশ্বাসকে তার ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।  ধর্ম সম্পর্কে বেশ কয়েকটি নীতিমালা রয়েছে যা নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ-

১. ধর্ম পালনের অধিকার নিরঙ্কুশ।  কোন ব্যক্তিকে তার ধর্ম পালনের জন্য কোনরকম বাধা দেওয়া যাবে না। জোরপূর্বক অন্য ধর্ম গ্রহণ করানো অথবা বর্জন করানো ইসলামে একেবারে অবৈধ। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি ধর্ম পালন ব্যক্তিগত বিষয়।  ইসলামের ধর্ম নিয়ে জোরপূর্বক কোনো চাপ সৃষ্টি করা হয়নি।

২. ইসলামে ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে। উভয়েই যার যার ধর্ম তা পালন করতে পারবে।  ইসলামে জোরপূর্বক ভাবে ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া হয় নাই।

৩. ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মানশীল হওয়া। অর্থাৎ ইসলামের ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে অন্যের অধিকারের প্রতি  সম্মানশিল হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ইসলামিক ধর্মের অধিকারের সুরক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ইসলামী রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো সকল নাগরিকের জন্য ধর্ম পালনের অধিকার সুনিশ্চিত করা। এজন্য রাষ্ট্রকে ধর্মীয় স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিতে হবে। এছাড়াও, রাষ্ট্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করবে।  ইসলামের  ধর্ম অধিকারের ক্ষেত্রে নারীদের অধিকার ও সমান থাকবে। ইসলামের ধর্মের অধিকার নীতিমালা গুলি মানব সমাজের জন্য একটি মডেল স্বরূপ। এগুলো যদি বাস্তবায়িত হয় তাহলে সমাজে ধর্মীয়  সহিষ্ঞতা বৃদ্ধি পাবে এবং সাম্প্রদায়িক সম্পদের বজায় থাকবে।

ইসলামে ধর্মের গুরুত্ব সম্পর্কে কুরআনে বেশ কিছু আয়াত রয়েছে তার মধ্যে একটি আয়াত হলঃ-
আল্লাহ তা'আলা বলেন, তোমরা এক আল্লাহর এবাদত কর এবং তার সাথে কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন, নিকটবর্তী প্রতিবেশী, দূরবর্তী প্রতিবেশী এবং তোমার সঙ্গী, পথিক সকলের সঙ্গে সদয় ব্যবহার কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারী  মানুষদের পছন্দ করেন না। (সুরা আল নিসা ৩৬)

বিচারের অধিকার

ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যায় বিচার পাওয়ার সবার অধিকার রয়েছে। ইসলামে বিচারের অধিকার কে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্যক্তি, পরিবার সমাজের সব সদস্যদের যেমন সমান আইন ও অধিকার প্রযোজ্য তেমনিভাবে ন্যায় বিচার পাওয়ারও অধিকার রয়েছে। ইসলামী বিধান অনুসারে, ইসলামী বিধি-বিধান পালনের ক্ষেত্রে যেমন সকলের সমানভাবে দায়িত্বশীল তেমনি সকলেই নিজ কাজের জন্য সমানভাবে পাপ বা পুণ্য লাভ করবে। যে কারণে ইসলামে অন্যায় কারীদের জন্য  রয়েছে কঠোর শাস্তি। ইসলামে বিচারের অধিকারের ক্ষেত্রে কোনো রকম বৈষম্য করা হয় না।

ইসলামে বিচারের অধিকারের মূলনীতি হলো, প্রত্যেক ব্যক্তিরই ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে।  ইসলামে ন্যায় বিচারকে আল্লাহর নির্দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা। ইসলামে বিচারের  অধিকারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু নীতিমালা রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নীতিমালা নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ-

১. ইসলামে বিচারের অধিকার নিরঙ্কুশ। অর্থাৎ, ইসলামে কোন ব্যক্তিকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। সকলকে তার অধিকার সমভাবে প্রদান করতে হবে।

২.  বিচারের ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষের সমান অধিকার।  ইসলামের বিচারের অধিকারী ক্ষেত্রে কোন রকম বৈষম্যতা করা যাবে না।

৩.  ইসলামিক বিচারের ক্ষেত্রে  পক্ষপাতহীন ভাবে বিচারকার্য সম্পাদন করতে হবে। অর্থাৎ ন্যায় পরায়ণভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতে হবে। কোন দিকে অন্যায় ভাবে রায় দেওয়া যাবে না।

ইসলামে বিচারের অধিকারের  সুরক্ষায় সকল নাগরিকের জন্য সুবিচারের অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। এজন্য রাষ্ট্র একটি ন্যায় সঙ্গত বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তার পাশাপাশি বিচারকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ সুবিধা প্রদান করতে হবে। সকলের অধিকার সমানভাবে সুনিশ্চিত করতে হবে। ইসলামে  বিচারের অধিকার নীতিগুলো মানব সমাজের জন্য একটি মডেল। যদি এই নীতিমালা গুলো বাস্তবায়িত হয় তাহলে সমাজের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে এবং সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। কোন ধরনের অন্যায় সমাজে সৃষ্টি হবে না।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তালা বলেন,  ”তোমরা যখন কোন বিভাগের বিচার করবে, তখন ন্যায় বিচার করো, আল্লাহ ন্যায় বিচার করতে পছন্দ করেন। আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা নিসা, আয়াত ৫৮)
মানুষের অধিকার সংশ্লিষ্ট হওয়ায় দক্ষভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ হওয়া এবং তার পাশাপাশি সমাজের নানা গভীর জ্ঞান ও সচেতনতা জরুরী হয়ে থাকে। কারণ সুবিচার বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়া মানে মানুষের অধিকার ক্ষুন্ন করা। সুতরাং সকল বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করে সুবিচার  প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

হাদিসের বিচারকদের ব্যাপারে কঠোর সতর্কবাণী এর নির্দেশ রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন, বিচারক তিন ধরনের হয়ে থাকে যার মধ্যে দুই ধরনের বিচারক জাহান্নমে যাবে এবং এক ধরনের বিচারক জান্নাতে যাবে। যে সকল বিচারকগণ জান্নাতে যাবে তাদের বৈশিষ্ট্য হলঃ-

১. যিনি সত্যকে জানবেন এবং সে অনুযায়ী বিচারকার্য সম্পাদন করবেন তিনি জান্নাতে যাবেন।
২. দ্বিতীয় হল সেই ব্যক্তি যে সত্যকে জানবে কিন্তু তা অনুসারে বিচারকার্য সম্পাদন করবে না এবং বিচারকার্যে অনিয়ম করবে সেই সকল বিচারকগণ জাহান্নামে যাবে।
৩. তৃতীয় হল সেই ব্যক্তি যিনি সত্যকে জানবে না, বুঝবেনা, অজ্ঞতা নিয়েই বিচারকার্য পরিচালনা করবে সেও জাহান্নাম প্রবেশ করবে।  (আবু দাউদ, হাদিসঃ- ৩৫৭৩)

রাসুলুল্লাহ সাঃ সমাজে সকলের জন্য সুবিচার প্রতিষ্ঠায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। অষ্টমী হিজরীতে মাখজুম  গোত্রের এক নারী চুরির অপরাধে অভিযুক্ত হন। তখন তাদের আত্মীয়-স্বজনরা ভয় পেয়ে ওসামা বিন জায়েদ (রাঃ)  এর মধ্যস্থায়ী রাসূলুল্লাহ সঃ এর কাছে সুপারিশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ওসামা বিন জায়েদ (রাঃ) এর কথা শুনে খুবই রাগান্বিত হন এবং তার চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন, তুমি কি আল্লাহর দন্ডবিতি নিয়ে সুপারিশ করেছ? বিকেলে তিনি খুতবা দেন। তাতে আল্লাহর প্রশংসা করে  বলেন, তোমাদের আগের যুগের মানুষ ধ্বংস হওয়ার একটি কারণ ছিল  তারা চুরি করলে ছাড় পেতো।

অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাঃ বলেন, ওই সত্তার শপথ, ”যার হাতে আমার প্রাণ, যদি ফাতেমা বিনতে মোহাম্মদ (আমার কন্যা) চুরি করে আমি তার হাতেও কেটে দেব।” অতপর  রাসূলুল্লাহ সাঃ  এর নির্দেশে সেই নারীর হাত কাটা হয়। পরবর্তীতে ওই নারী তওবা করেন এবং বিয়ে করেন। আয়েশা রাঃ বলেছেন,  অতঃপর বিভিন্ন প্রয়োজনে সেই নারী আসতো এবং তার কথা শুনে আমি রাসুল সাঃ এর কাছে বলতাম।  (সহীহ বুখারী, হাদিস ৪৩০৪)

উক্ত আলোচনাগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠা মানে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান। আমরা আরও বলতে পারি ইসলাম সুরক্ষা মানে হল মানবাধিকারের সুরক্ষা ও বাস্তবায়ন। মানব অধিকার সুরক্ষা করা সচেতন ও সামর্থ্যবান সব নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব এর মধ্যে একটি। সকল মুসলিমদের ঈমানী কর্তব্য এটি।

কমেন্ট

Previous Post Next Post